
সালটা ছিল ১৯৪৭, সবে ভারত ভাগ হয়েছে। পূর্ববঙ্গের ভারতীয়রা হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানি হয়ে গেছে। বরিশালের নলচিড়া গ্রামের বছর চোদ্দোর ছেলে বাদল, ভালো নাম প্রফুল্ল কমল সেনগুপ্ত, লোকের মুখে শোনে ‘দাঙ্গা’ বলে কী একটা যেন চারদিকে হচ্ছে। হিন্দু-মুসলমানে মারপিট হচ্ছে। হিন্দুরা সব প্রাণের ভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিচ্ছে। আর মুসলমানরা সব পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসছে।
ঐক্য যে কারণে জরুরি
বরিশালের নলচিড়া গ্রাম অবশ্য চিরকালের শান্তিপ্রিয় জায়গা, সেখানে এরকম কোনো ঘটনা তখন পর্যন্ত ঘটেনি। কিন্তু ঘটতে কতক্ষণ, তাই সবার মনে চাপা উৎকণ্ঠা। অনেকেই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না, চলে যাচ্ছেন গ্রাম ছেড়ে। শৈশবে পিতৃহারা বাদল বেড়ে উঠেছিল তার ঠাকুরদা-ঠাকুমার স্নেহচ্ছায়ায়। ঠাকুরদা বিশ্বেশ্বর সেনগুপ্ত ভরসা পাচ্ছিলেন না একমাত্র নাতিকে এই অস্থির অবস্থার মধ্যে রাখতে। এই পরিস্থিতিতে নলচিড়া হাইস্কুলের মাঠে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত শান্তি কমিটি এক মিটিং ডাকল। কিশোর বাদলও পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল স্কুল মাঠে। মিটিং শুরু হলো, কয়েক জন বক্তব্য রাখার পর হঠাত্ই মঞ্চে উঠে পড়ল তোফেল (তোফায়েল) মিঞা। শোনা যায় এই তোফেল নাকি একসময় ডাকাত ছিল, পরবর্তী সময়ে অন্যের জমিতে চাষাবাসের কাজ করে, একটু রগচটা প্রকৃতির মানুষ। তোফেল মঞ্চে উঠেই এক হুংকার দিয়ে বললেন, ‘সব হিন্দুগো কাইটগা থুমু...’ শান্তি কমিটির লোক মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। হিন্দুদের বুক কেঁপে ওঠে। এই বুঝি দাঙ্গা লাগে আর কি! তোফেল কিন্তু তার বক্তব্য তখনো শেষ করেননি, তার পরের কথাটা ছিল—‘...যদি একজন হিন্দুও গ্রাম ছাইড়্যা যাইতে চায়!’হূদয়ের চেয়ে বড় আর কী আছে?কিশোর হলে কী হয়, আবেগপ্রবণ বাদলের চোখের কোল বেয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে নেমেছিল সেদিন। যদিও বাদলকে শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তেই হয়েছিল, তবে দাঙ্গার জন্য নয়, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু জীবনের শেষ পর্যন্ত তোফেল মিঞাকে ভোলেনি বাদল, ভুলতে পারেনি। সেই তোফেল মিঞা যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল না কিন্তু একটা বিরাট হূদয় ছিল। নলচিড়ার প্রতি বাদলের টানও ছিল অমোঘ। ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে বলত—যেই মুহূর্তে মৃত্যু হবে, আত্মা নলচিড়াতে চলে যাবে।’
এই বাদল আর তোফেলরাই কিন্তু প্রকৃত বাঙালি, যারা আবেগে কাঁদে আবার জাতি-ধর্মনির্বিশেষে মানুষকে আত্মীয়জ্ঞানে বুকে টেনে নিতে পারে। এই লেখা শেষ করব বাদলের জীবনের শেষ পর্বের একটি ঘটনা দিয়ে। বিপত্নীক হওয়ার পর জীবনের শেষ ৯ মাস তাকে ২৪ ঘণ্টা দেখাশোনা করত যে পারুল নামের মেয়েটি, সে ছিল মুসলিম, বাদলকে সে বাবা ডাকত। বাদলের মৃত্যুর পর তার মেয়ের সঙ্গে সেই পারুলও গিয়েছিল শ্মশানঘাটে। বাদলের মৃতদেহের মাথার তলায় নিজের হাত দুটো দিয়ে বসেছিল পারুল, তার বাবার মাথায় ব্যথা লাগবে বলে। বাদলের মেয়ে যখন মুখাগ্নি করবে তখন সরতে হয়েছিল পারুলকে, সে তার গায়ের ওড়নাটা খুলে দিয়ে দিয়েছিল তার হিন্দু বাবার মাথার নিচে। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আমার বাবা চলে গেল, ওড়না দিয়ে কী হবে? ওটা থাক বাবার মাথার তলায়।’ বাদলের হিন্দু মেয়ে মুখাগ্নি করেছিল আর মুসলিম মেয়ের ওড়না মাথার নিচে নিয়ে তার নশ্বর দেহ ঢুকেছিল চুল্লিতে।